আস্থা সংকট : ৬ মাসেও পূর্ণাঙ্গ হয়নি ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি

BNPবিএনপির আন্দোলনে ‘ভ্যানগার্ড’ খ্যাত ছাত্রদল গৌরবময় ঐতিহ্য হারাচ্ছে। সহযোগী সংগঠন হিসেবে বিগত আন্দোলনে কোনো ধরনের সক্রিয় কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামতে পারেনি এই ছাত্র সংগঠন।
রাজপথের আন্দোলনে সংগঠনটির পর পর দুই কমিটি ব্যর্থ হয়েছে। ফলে দলের মধ্যে আস্থা সংকটে পড়েছে সংগঠনটি। এর জন্য সাংগঠনিক দুর্বলতাকে দায়ী করছেন সংগঠনের কর্মীরা। তবে ঘুরে দাঁড়াতে সংগঠন পুনর্গঠনের কাজ চলছে বলে জানা গেছে।
সংগঠনের কর্মীদের দাবি, ছাত্রদলের দায়িত্বপ্রাপ্তরা বর্তমান কমিটির বয়স ছয় মাস পার হলেও এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে পারেনি। পুনর্গঠন করা হয়নি কোনো ইউনিট কমিটিও।
ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি নেতারা
গত ৫ জানুয়ারি থেকে বিএনপি সক্রিয় আন্দোলনে ছাত্রদলের শীর্ষনেতারা আত্মগোপনে চলে যান। ফলে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা আন্দোলনে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তবে ছাত্রদল সূত্রে জানা যায়, সংগঠনটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আত্মগোপনে থেকে আধুনিক প্রযুক্তি (ভাইবার) ব্যবহার করে তাদের আস্থাভাজন কিছু নেতাকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। এক্ষেত্রে যাদের স্মার্টফোন আছে তারাই কেবল এই যোগাযোগটা রক্ষা করতে পেরেছেন। এ ছাড়া সারাদেশে সংগঠনের নেতাকর্মীরা ছিল কেন্দ্রীয় নেতাদের কাজ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন।
সদ্য সমাপ্ত সিটি নির্বাচনের প্রচারণার সময় পর পর দুই দিন খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা হয়। এরপর খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসে ছাত্রদল। খালেদা জিয়ার নিরাপত্তায়ও দেখা যায় তাদের। যদিও ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে আবারও বাংলামোটরে হামলার মুখে পড়ে খালেদা জিয়ার গাড়িবহর। এ যাত্রায় ছাত্রদল নেতাকর্মীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে খালেদা জিয়াকে রক্ষার চেষ্টা করেন। তারপরও খালেদা জিয়ার বেশ কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মী প্রতিপক্ষের হামলায় আহত হন। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের দমন-পীড়নের খবর না থাকলেও ছাত্রদলের শীর্ষনেতারা প্রকাশ্যে নেই।
আত্মগোপনে সভাপতি-সা.সম্পাদক
সংগঠনটির সূত্রে জানা যায়, সারাদেশে ছাত্রদল নেতাকর্মীদের নামে হাজার হাজার মামলা থাকলেও বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নামে তুলনামূলকভাবে মামলা কম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, গত বছর ২৪ ডিসেম্বর বকশীবাজার আলিয়া মাদ্রাসায় বিশেষ আদালতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া হাজিরা দেওয়ার সময় ছাত্রদলের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেওয়া মামলাটি। ওইদিন হামলার শিকার হন সংসদ সদস্য ছবি বিশ্বাস। এতে বিএনপিসহ দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সাবেক ও বর্তমান অনেক শীর্ষনেতার নামে মামলা হয়। ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রাজিব এবং আকরামুলের নাম আসে।
ছাত্রদল সভাপতি রাজিব আহসান ও সাধারণ সম্পাদক মো. আকরামুল হাসান আত্মগোপনে থাকায় তাদের পাওয়া যায়নি। মোবাইলে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
ছাত্রদলের সহ-সভাপতি নাজমুল হাসান জানান, আন্দোলনে ছাত্রদলের শীর্ষনেতারা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে, প্রতিটি ইউনিটের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন। হয়ত তারা প্রকাশ্যে মিছিল করতে পারেননি।
ছাত্রদল সভাপতির নামে প্রায় ৩০টি মামলা ও সাধারণ সম্পাদকের নামে প্রায় ২০টি মামলা রয়েছে বলেও জানান তিনি।
ছাত্রদল নেতাকর্মীদের মধ্যে অনেকেরই দাবি— গুম, হত্যার হুমকি, ধরে নিয়ে সরাসরি গুলি করা হয়েছে। অনেকেই পঙ্গুত্ববরণ করেছে। সরকারের এমন দমন-পীড়নের কারণে রাজপথের আন্দোলনে ছাত্রদল স্বরূপে ফিরতে পারেনি। ক্ষমতাসীনদের অগণতান্ত্রিক আচরণের মুখে ছাত্রলীগ পড়লে তাদের এর চেয়েও করুণ অবস্থা হতো। তারপরও আমরা ঘুরে দাঁড়ানো জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছি। এমনিতেই ছাত্রদল আস্থা সংকটে পড়েছে। ফলে এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না।
বকশীবাজারে ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হন ছাত্রদলকর্মী কাওসার মাহমুদ। দ্য রিপোর্টকে তিনি বলেন, নিয়মিত ছাত্রদের দিয়ে কমিটি করতে হবে। ছাত্রদল সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হলে ওইদিন (বকশীবাজারে ঘটনা) ছাত্রলীগ হামলা করার সাহস করত না। ওইদিনের ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু তা হয়নি।
ছাত্রদলকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
২০১২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর আব্দুল কাদের ভুঁইয়া জুয়েলকে সভাপতি ও হাবিবুর রশীদ হাবিবকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রদলের কমিটি গঠন করা হয়। তারা আন্দোলনে ব্যর্থ হলে দুই বছরের মাথায় গত বছর ১৪ অক্টোবর নতুন কমিটি দেওয়া হয়। রাজিব আহসানকে সভাপতি ও মো. আকরামুল হাসান সাধারণ সম্পাদক করে বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ২০১ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করেন।
রিস্ক নিতেইহবে
ছাত্রদলের বর্তমান নেতৃত্ব প্রসঙ্গে বিএনপির সহ-তথ্য গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান হাবীব বলেন, ‘ছাত্রদলকে রিস্ক নিতেই হবে। যদিও আওয়ামী লীগ সংগঠিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি দিচ্ছে না। ছাত্রনেতারা তাদের কার্যালয়ে আসতে পারছে না। কোথাও এক সঙ্গে বসার সুযোগ নেই।’
এই হাবিবুর রহমান হাবীবই ৯০-এর দশকে ছিলেন ছাত্রলীগের সভাপতি।
তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সকল দমন-পীড়নের কথা মাথায় রেখেই দেশের প্রয়োজনে ছাত্রদলকে এগিয়ে আসতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘নব্বইয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও বর্তমান পরিস্থিতি এক নয়। এরশাদের কোনো ছাত্র সংগঠন ছিল না। ছাত্র সমাজও তাকে ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু বর্তমানে মূল দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ আছে। এ ছাড়া প্রশাসন তাদের যেভাবে সহযোগিতা করছে এমন অবস্থায় রাজপথে নামা কঠিন।’
ছাত্রদলে আস্থার সংকটের অভাবের বিষয়টি সরাসরি না স্বীকার না করলেও তিনি বলেন, ‘ছাত্রদল পরিস্থিতির শিকার। এমন অবস্থায় পড়লে আওয়ামী লীগও টিকতে পারত না।’
শিগগিরই পুনর্গঠন হবে ছাত্রদল
ছাত্রদলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে সরকারবিরোধী আন্দোলনের কথা মাথায় রেখে ইতোমধ্যে যোগ্য, ত্যাগী ও সাহসী নেতৃত্ব সামনে এনে ছাত্রদল পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে ছাত্রদলের সাংগঠনিক নেতা হিসেবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার তাগিদ রয়েছে বলেও জানা গেছে।
সংগঠনের সহ-সভাপতি বর্তমানে দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত নাজমুল হাসান ছাত্রদল পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
তিনি বলেন, ‘সংগঠন পুনর্গঠন নিয়মিত কাজ। যারা সংগঠনের দায়িত্বে আছেন তারা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন। আশা করছি, নিয়মিত ছাত্র, দক্ষ, যোগ্য, ত্যাগী ও সাহসী নেতৃত্ব সামনে এনে ছাত্রদল পুনর্গঠন করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নির্দেশক্রমেই আমি বর্তমানে ছাত্রদলের দফতরের কাজগুলো করছি। কমিটি পুনর্গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত কিছুই বলতে পারব না।’
ছাত্রদল সূত্রে জানা গেছে, কমিটি পুনর্গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে নিয়মিতই ছাত্রদল সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মিটিংয়ে বসছেন। গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট বিবেচনায় কমিটিগুলো পুনর্গঠন করা হবে। পাশাপাশি মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটিগুলো নতুন করে দেওয়া হবে। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ ছাত্রদল কমিটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল কমিটি, জগনাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল কমিটি ও ঢাকা মহানগর থানা ইউনিট কমিটিগুলোও পর্যাক্রমে পুনর্গঠন করা হবে। এ সব কমিটি গঠনে এরই মধ্যে নেতৃত্ব বাছাইয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। খুব শিগগিরই তা চূড়ান্ত করা হবে। এ ছাড়া সারাদেশেই পর্যায়ক্রমে ছাত্রদলের কমিটিগুলো পুনর্গঠন করা হবে।
সম্ভাব্য কমিটি
ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদলে নেতৃত্বে আসার সম্ভাবনা রয়েছে— বর্তমান কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি শরিফ উদ্দিন জুয়েল, সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান রাজ, তেজগাঁও কলেজ শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম জাকির (বর্তমানে নিখোঁজ) মিরপুর থানা ছাত্রদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি ফিরোজ আলম, ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের শফিকুল ইসলাম মিঠুন প্রমুখ।
এ ছাড়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদলে নেতৃত্বে আসার সম্ভাবনা রয়েছে— বর্তমানে সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনামুল হক এনাম, সিনিয়র যুগ্ম-সম্পাদক জহির উদ্দিন তুহিন, মতিঝিল থানা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি গিয়াস উদ্দিন মানিক, কামরাঙ্গির চর থানা ছাত্রদলের সভাপতি এম এ গাফফার প্রমুখ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল কমিটিতে আলোচনায় রয়েছে— কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি মাসুম বিল্লাহ, মনিরুল ইসলাম, মামুন বিল্লাহ, ইখতিয়ার রহমান কবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাসুদ পারভেজ। কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক আসাদুজ্জামন আসাদ, মিয়া মোহাম্মদ রাসেল, মিজানুর রহমান সোহাগ, মফিজুর রহমান আশিক, আব্দুল করিম সরকার, বায়েজিদ আরেফিন, আব্দুর রহমান রানা, কাজী মুক্তার হোসেন, আব্দুর রহিম সেতু, হাসানুল বান্না, নুরুল হুদা বাবু। ছাত্রনেতা আল মেহেদী তালুকদার (কারাগারে আটক), আব্দুল বাশার, রওনোকুল হাসান শ্রাবণ, আহসানুল হক শুভ্র ও মাইনুল ইসলাম। এ ছাড়া একমাত্র ছাত্রনেত্রী কেন্দ্রীয় শাহিনূর নার্গিস।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend