বৃষ্টি জলাবদ্ধতা যানজটে বিপর্যস্ত রাজধানী
অবিরাম বর্ষণে ভেসে গেল পথ। রাজধানীর যেখানেই রাস্তার কোনো অংশ ঢালু, সেখানেই অথই পানি। সাইলেন্সার পাইপে পানি ঢুকে বিভিন্ন রাস্তায় থমকে দাঁড়ানো সিএনজিচালিত অটোরিকশা। চালকদের চেহারায় বিরক্তি, হতাশা, সংশয়। গতকালই গ্যাসের দাম বেড়েছে, গাড়ি না চললে দিনের হিসাব মেলানো কঠিন হবে।
প্রতিটি রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্থির হয়ে আছে ‘চলমান’ যানবাহন। বাস, ট্রাক, মিনিবাস, প্রাইভেট কার, লেগুনা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা —কে নেই সেই দলে। এর সঙ্গে যোগ হয় রিকশা। ফলে যানজটের কারণে রাজধানীর বিরাট অংশের স্থবির চিত্রের ষোলোকলা পূর্ণ।
গতকাল মঙ্গলবারের বৃষ্টিতে দুর্ভোগ, যানজট আর জলাবদ্ধতায় বিপর্যস্ত নগরজীবনের চিত্রটা ছিল এ রকম। বৃষ্টির বিদায়ের পরেও যানজট এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, আধা ঘণ্টার পথ পৌঁছতে দুই ঘণ্টা, তিন ঘণ্টা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছয় ঘণ্টাও লেগে যায়।
গতকাল বেলা ১১টা থেকে বৃষ্টি শুরু। ধীরে ধীরে এর বেগ বাড়তে থাকে। মাত্র দেড় ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ৪২ মিলিমিটার। বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় মধ্য ঢাকার তল্লাবাগ, শুক্রাবাদ, গ্রিন রোড, ইন্দিরা রোড, পরীবাগ, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, গার্ডেন রোড, সোনারগাঁও হোটেল এলাকাসহ অনেক এলাকা। বৃষ্টির পর নগরজুড়ে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজটের।
অল্প সময়ে অতিবৃষ্টি, ঢাকা ও চারপাশের নদীগুলোর পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়া এবং হাতিরঝিল থেকে যে পথে পানি নিষ্কাশিত হয় (ডাউন), সে পথে পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় গতকাল ভয়াবহ জলাবদ্ধতা তৈরি হয় বলে বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তারা বলছেন।
গতকালের জলাবদ্ধতার নতুন দিক ছিল মধ্য ঢাকা বা হাতিরঝিলের চারপাশের এলাকাগুলো তলিয়ে যাওয়া। হাতিরঝিল প্রকল্প চালুর পর এ ধরনের জলাবদ্ধতা আর হয়নি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষক ও হাতিরঝিল প্রকল্পের পরামর্শক মো. মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মধ্য ঢাকায় জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ হচ্ছে হাতিরঝিলের ডাউনে পানি বেড়ে যাওয়া। রামপুরায় রেগুলেটর গেট ছিল বন্ধ। হাতিরঝিলের মধ্যেই সব পানি জমা ছিল। ডাউনে পানি বেশি থাকায় চারপাশের পানি হাতিরঝিলে যাচ্ছিল অত্যন্ত ধীরগতিতে।
অধ্যাপক মুজিবুর রহমান আরও বলেন, কারওয়ান বাজারের পানি হাতিরঝিলে যাওয়ার সঠিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা এখনো হয়নি। এ জন্য বাজার এলাকায় সন্ধ্যার সময়ও পানি জমে ছিল। যদিও ভবিষ্যতে এ বিষয়ে কাজ হবে।
গতকাল ভয়াবহ জলাবদ্ধতার জন্য অতিবৃষ্টি ছাড়াও ঢাকা ও চারপাশের নদীগুলোর পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করেছে ঢাকা ওয়াসা। সংস্থার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) এ ডি এম কামরুল আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালুসহ ঢাকা ও চারপাশের নদীগুলোর উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে পানিনিষ্কাশন পাম্প চালু করতে হয়েছে পুরোপুরি। রামপুরা স্লুইসগেটের কাছে পাম্পিং স্টেশন চালু রাখা হয়েছে সার্বক্ষণিকভাবে। এ ছাড়া ধোলাইখাল, কল্যাণপুর ও গোড়ান চটবাড়ীতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাম্প চালু রাখা হয়। জনপদে অস্থায়ী ১৫টি পাম্প চালু ছিল। তিনি বলেন, আবহাওয়া দপ্তর যে পরিমাণ বৃষ্টিপাতের কথা বলেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি বৃষ্টি হয়েছে ঢাকায়। ঢাকা ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের ড্রেনেজ ব্যবস্থা অতিবৃষ্টির সঙ্গে পেরে ওঠেনি।
দুর্ভোগ: গাবতলী থেকে নিউমার্কেটে আসা মিরপুর রোডটি চলনশক্তিহীন হয়ে কাটিয়ে দিল দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত। আড়মোড়া ভেঙে মাঝে মাঝে একটু সচল হলেও তাকে গতি বলা যায় না। পথে আটকে পড়া কারও মোবাইলে স্পষ্ট বিরক্তির আভাস, ‘আরে! দেড় ঘণ্টা আটকে আছি একই জায়গায়।’ তার কথায় সায় দেয় আশপাশের কেউ কেউ। পুঞ্জীভূত ক্ষোভ কার ওপর ঝাড়বেন, সেটা বুঝতে না পেরে অসহায়ের মতো অনেকেই কেবল দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছেন। আসাদগেট থেকে ফার্মগেটের দিকে যাওয়া যাবে না বুঝতে পেরে অনেকেই গাড়ি ঘুরিয়ে গণভবন হয়ে ক্রিসেন্ট লেকের দিকে যান। কিন্তু বিজয় সরণির মোড়ের কাছাকাছি যেতেই তাঁরা বুঝতে পারেন, এই রাস্তাও স্থবিরতাকেই আলিঙ্গন করেছে। অনেক পরে যখন বিজয় সরণি পার হওয়ার সুযোগ হলো, তখন দেখা গেল সামনেই অথই সাগর! ডান দিকে যে রাস্তাটা চলে গেছে ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের দিকে, সেখানে ফুটপাতের চিহ্ন নেই। সবকিছু ডুবে গেছে।
গ্রিন রোড নিজের চেহারা বদলে ততক্ষণে বহমান নদী। অবিরাম রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে এমনিতেই কোথায় খানাখন্দ, তা টের পাওয়া যায় না; আর পানিতে রাস্তা ভেসে যাওয়ায় পথচলতি মানুষেরা হয়ে পড়েছেন হতবিহ্বল। এ সময় চলতে গিয়ে এলাকার ভ্যানচালকদের সাহায্য নিয়েছেন অনেকেই। গ্রিনলাইফ হাসপাতালের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ভ্যানচালকেরা চিৎকার করছেন, ‘নদী পারাপার! নদী পারাপার!’ দুর্ভোগের মধ্যেও এই রসিকতায় মানুষের মনে একটু হলেও আনন্দের সঞ্চার হয়।
পান্থপথের কাছে একটি মাইক্রোবাস থেকে ভেসে আসছিল গানের আওয়াজ। সে আওয়াজ ছিল যথেষ্ট উচ্চগ্রামে বাঁধা। একজন রিকশাচালক রসিকতা করে বলছিলেন, ‘এইটাই করতে লাগবে। নাইলে দিন কাটবে না।’ আরেক রিকশাচালক তাঁর কথায় সায় দিলে বললেন, ‘আমি মহাখালী থিকা ফারমগেট আসছি চাইর ঘণ্টায়!’
শান্তিনগর, বেইলি রোড, সার্কিট হাউস রোড, মালিবাগ, রাজারবাগ এলাকায় গাড়ি চললে ঢেউ ওঠে। সেই ঢেউ আছড়ে পড়ে রাস্তার পাশে ভবনের দেয়ালে। মালিবাগ থেকে রাজারবাগের দিকে নতুন যে উড়ালসেতুটি হচ্ছে (মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার), সেখানে ঢেউ ওঠে ঘোলা পানির।
শাহবাগে বৃষ্টি কমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা পার্থ প্রতিম। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বৃষ্টি কমার পর একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ওঠেন তিনি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শাহবাগ থেকে ফার্মগেট আসতে তাঁর সময় লেগেছে দেড় ঘণ্টারও বেশি। একদিকে বৃষ্টি, আরেকদিকে সড়কে জলাবদ্ধতার কারণে অটোরিকশা থেকে নেমে হেঁটে যাওয়াও সম্ভব হয়নি।
প্রধান সড়কগুলোর মধ্যে বিমানবন্দর সড়কের বনানী অংশে যানজট ছিল বেশি। এই সড়কের বেশির ভাগ অংশই পানিতে তলিয়ে যায়। বিজয় সরণি ও কারওয়ান বাজার সিগন্যালে গাড়ির চাপ ছিল বেশি। বিভিন্ন স্থানে পানি জমে যাওয়ায় মিরপুর রোড, সাতরাস্তা সড়কেও দেখা দেয় তীব্র যানজটের। এ ছাড়া রামপুরা থেকে কাকরাইল মোড়, মৌচাক থেকে মগবাজার পর্যন্ত সড়কগুলোতে যানবাহন চলেছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। এসব সড়কে ভ্যান ও রিকশা গর্তে পড়ায় ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটতে দেখা যায়।
মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, ধানমন্ডি, পান্থপথ, গ্রিন রোডসহ বিভিন্ন এলাকার সড়কে যানবাহন থমকে ছিল। অ্যাম্বুলেন্সগুলোকেও ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। যানজট মোকাবিলায় ট্রাফিক পুলিশ অনেক এলাকায় উল্টোপথে গাড়ি চলাচলের সুযোগ করে দিয়েছে।
টানা বৃষ্টিতে মিরপুরের কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়ার বিভিন্ন রাস্তা ডুবে যায়। কোথাও কোথাও দোকানপাট ও বাড়ির নিচতলায় পানি ঢুকে পড়ে। এসব এলাকায় ওয়াসার লাইনের উন্নয়নকাজ চলার কারণে বিভিন্ন স্থানে রাস্তা কাটা থাকায় এলাকাবাসীকে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়। কাজীপাড়ার ইব্রাহিমপুরের আশি দাগ মোড় এলাকায় এক বাড়িতে ভেতরে পানি ঢুকে পড়েছে। আর বাড়ির বাসিন্দারা বালতি দিয়ে সেই পানি বের করার চেষ্টা করছেন।