‘বিচারক হত্যা নয়, আত্মহত্যা’ : স্ত্রী-শাশুড়িসহ ৫ জন আসামি
চট্টগ্রামে নওগাঁর অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ কাজী আবদুল হাসিব মোহাম্মদ সাঈদকে হত্যা করা হয়েছে- দ্বিতীয়বারের ময়নাতদন্তে এমন রিপোর্ট আসার পরপরই স্ত্রী-শাশুড়িসহ ৫ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে সিআইডি।
সিএমপির সহকারী কমিশনার (প্রসিকিউশন) নির্মলেন্দু বিকাশ চক্রবর্তীর কাছে মঙ্গলবার বিকেলে অভিযোপত্র জমা দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডি চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিদর্শক কাজল কান্তি চৌধুরী। এতে নিহত বিচারকের দ্বিতীয় স্ত্রী সানজিদা আহমেদ মিশু, মিশুর মা লাকী আকতার, ভাই ইমরান, বাবা নাছির উদ্দিন ও কাজের বুয়া রীমা আক্তারকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
নির্মলেন্দু বিকাশ চক্রবর্তী বিচারক হত্যার অভিযোগপত্র পাওয়ার কথা স্বীকার করে দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নিয়মানুযায়ী অভিযোগপত্রটি সিলগালা করে শুনানির দিন চট্টগ্রামের চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে উপস্থাপন করা হবে।
এ ব্যাপারে সিআইডি চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাজল কান্তি চৌধুরী দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিচারক সাঈদ হত্যা মামলার চূড়ান্ত অভিযোগপত্রে স্ত্রী শাশুড়িসহ ৫জনকে আসামি করা হয়েছে, সাক্ষী রাখা হয়েছে ৪৮ জনকে। মামলার তদন্তে ‘আত্মহত্যা নয়, তাকে খুন করা হয়েছে’ বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
জানা যায়, ২০১৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর নওগাঁ জেলার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ কাজী আবদুল হাসিব মো. সাইদের চট্টগ্রাম মহানগরীর হালিশহরের মোল্লপাড়াস্থ দ্বিতীয় স্ত্রীর বাড়িতে রহস্যজনক মৃত্যু হয়। স্ত্রী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন আত্মহত্যা বলে প্রচার করলেও বিচারকের মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাতের চিহ্ন ছিল।
প্রথমদিকে বিচারক সাঈদকে আত্মহত্যার কথা বলা হলেও দ্বিতীয়দফার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও সিআইডির অধিকতর তদন্তে পরিকল্পিত হত্যার বিষয়টি উঠে আসে। প্রথম ময়নাতদন্তে আত্মহত্যা বলা হলেও ঘটনার প্রায় ১৪ মাস পর হত্যাকাণ্ডে দ্বিতীয় স্ত্রীসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত অভিযোগপত্র তৈরি করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর রাতে নগরীর হালিশহরের মোল্লাপাড়ার একটি বাসায় রহস্যজনকভাবে গুরুতর আহত হন বিচারক সাঈদ। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান তার দ্বিতীয় স্ত্রী সানজিদা আহমেদ মিশু ও মিশুর মা লাকী আকতার। হাসপাতালে নেওয়ার পরপরই কর্তব্যরত ডাক্তার সাঈদকে মৃত ঘোষণা করেন। হাসপাতাল থেকেই আটক করা হয় সানজিদা ও লাকীকে। ওইদিন রাতেই হালিশহরের মোল্লাপাড়ার বাসা থেকে আটক করা হয় মিশুর ভাই ইমরান ও বিচারকের বাসার কাজের বুয়া রীমা আক্তারকে।
ঘটনার পর লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন হালিশহর থানার এসআই মোহাম্মদ মুকুল মিয়া। পর দিন (১৭ সেপ্টেম্বর) বিচারক সাঈদের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়। বিচারকের মাথায় আঘাতের চিহ্ন থাকায় এসআই মুকুল মিয়া বাদী হয়ে পাঁচজনকে আসামি করে হালিশহর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। তবে এখনো পলাতক রয়েছেন মিশুর বাবা নাছির উদ্দিন।
প্রথমে মামলাটি হালিশহর থানা-পুলিশ তদন্ত করে। গত বছরের ২ নভেম্বর থেকে পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে সিআইডি চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিদর্শক কাজল কান্তি চৌধুরী মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব নেন। এরপর গত বছরের ২৩ নভেম্বর মৃত্যুর দুই মাস পর মামলার নতুন তদন্ত কর্মকর্তা কাজল কান্তি চৌধুরীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম ফরিদ আলম বিচারক সাঈদের (৪৭) লাশ কবর থেকে তুলে ফের ময়নাতদন্তের আদেশ দেন। এরপর গত বছরের ২ ডিসেম্বর ঢাকার বনানী কবরস্থান থেকে ঢাকার একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে মরদেহ তোলা হয়। কিন্তু দুই মাস পর মরদেহ তোলায় সেটি পচে গলে যাওয়ায় সীমিত আকারে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়।
প্রথম ময়নাতদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বিচারক সাঈদকে হত্যা করা হয়নি, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যাজনিত শ্বাস বন্ধের কারণে তিনি মারা গেছেন। তবে সিআইডির অধিকতর তদন্তে ও দ্বিতীয় দফায় ময়নাতদন্তের পর তাকে মাথায় আঘাত দিয়ে জখম করে মৃত্যু নিশ্চিতের পর ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করার নাটক করার চেষ্টা হয়েছে বলে সিআইডির তদন্তে উঠে এসেছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, নওগাঁ জেলার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ কাজী আবদুল হাসিব মোহাম্মদ আবু সাঈদ কয়েক বছর আগে চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম সিনিয়র মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত থাকাকালে ভারপ্রাপ্ত সিএমএম ও অতিরিক্ত সিএমএম’র দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি যুগ্ম-জেলা জজ হিসেবে পটিয়া আদালতে কর্মরত ছিলেন। চট্টগ্রামে কর্মরত থাকাকালে দুইজন আইনজীবী বিচারক সাঈদকে মিশুর মা লাকীর ডবলমুরিং থানার পানওয়ালাপাড়ার ভাড়াবাসায় নিয়ে আসেন এবং মিশুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। গত ১২ সেপ্টেম্বর বিচারক কাজী আবদুল হাসিব মোহাম্মদ সাঈদ নওগাঁ থেকে চট্টগ্রামের মোল্লাপাড়ার বাসায় আসেন। ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি সেই বাসায় রহস্যজনক অবস্থায় খুন হন।