মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত : ফখরুল
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘শুধু বাংলাদেশ নয়, দুনিয়াজুড়ে মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। আরবে বিমান থেকে বোমা মেরে লাখ লাখ নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। তাদের ঘর থেকে বের হতে দেওয়া হচ্ছে না। মানবাধিকার নিয়ে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড চলছে। একদিকে মানবাধিকারের কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। যারা লঙ্ঘন করছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।’
রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সেমিনার হলে বৃহস্পতিবার বিকেলে এক আলোচনা সভায় তিনি এ সব কথা বলেন। জাতিসংঘ ঘোষিত মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে এ আলোচনার আয়োজন করে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি।
‘দেশে শান্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন’— মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সারাদেশে অসংখ্য নেতাকর্মী গুম, অনেকেই পঙ্গু। পুলিশ ধরে নিয়ে তাদের পঙ্গু বানিয়েছে। ক্রসফায়ারে যে কত মানুষ নিহত হয়েছে ইতোমধ্যে তা প্রকাশিত হয়েছে। সরকার একদিকে মানবাধিকারের কথা বলছে, অন্যদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘বাংলাদেশের সবকিছুই আছে, আবার কোনো কিছুই নেই। বিচার বিভাগ আছে। কিন্তু স্বাধীনতা কতটুকু আছে, তা নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন আছে।’
‘সরকারের পরিবর্তন হবে’— উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্র ফিরে পেতে চাই। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ফিরে পেতে চাই। মানবাধিকার ফিরে পেতে চাই। এটার জন্যই আমাদের সংগ্রাম। ছোট শিশুরা বড় হওয়ার আগেই গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে সংগ্রাম করতে হবে।’
আওয়ামী লীগের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘সঠিক পথ হবে, দেশে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন। এটা আপনারা এককভাবে সমাধান করতে পারবেন না। আমরা এ ধরনের ঘটনা কখনই চাই না। তাই সকল গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।’
কান্না যখন বক্তব্যকে ছাপিয়ে যায়
আলোচনা সভায় গুম হওয়া পরিবারের বেশ কয়েকজন বক্তব্য রাখেন। তারা প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তাদের সন্তানদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান। এ সময় সভাস্থল গুম হওয়া পরিবারের সদস্যদের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে।
গুম হওয়া বংশাল থানা ছাত্রদলের সদস্য সোহেলের বাবা শামছুর রহমান বলেন, ‘আমার ছেলেকে দিনের বেলায় শাহবাগ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তার ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে সে ফুল কিনতে গিয়েছিল, সেখান থেকে আর ফেরেনি।’
‘তাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব কী সরকারের নয়’— এমন প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আল্লাহরওয়াস্তে আমাদের সন্তানদের ফিরিয়ে দিন, আমরা বাঁচতে চাই।’
গুম হওয়া আরেক ছাত্রদল সদস্য মো. জহিরের মা হোসনে আরা বেগম বলেন, ‘আমার সন্তানের খোঁজ এখনো পাইনি। তার বাবা মৃতপ্রায়। আমরা ছেলের সন্ধান চাই। এমনিতেই সন্তানের খোঁজ পাইনি তারপর প্রায় প্রতিদিনই পুলিশ বাসায় গিয়ে টাকা চায়। আমরা আর কান্না করতে পারব না। সরকারকে বলব আমাদের সন্তানদের ফেরত দিন।’
৭৯ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি খালিদ হাসান সোহেলের স্ত্রী বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন অপেক্ষায় থাকি কবে সোহেল ফিরে আসবে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন, আমার স্বামীকে ফেরত দিন।’
গুম হওয়া ছাত্রদল নেতা পারভেজের শিশুকন্যা হৃদি (৪) বলে, ‘শেখ হাসিনা আন্টি, আপনি আমার পাপাকে ছেড়ে দিন। আমরা আপনার জন্য দোয়া করব। প্লিজ পাপাকে ছেড়ে দিন। আমি স্কুলে যাব, চকলেট খাব।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে গুম হওয়া ছাত্রদল নেতা চঞ্চলের ছেলে আহাদ আলী (৫) বলে, ‘শেখ হাসিনা আন্টি, আপনি আমরা পাপাকে ছেড়ে দিন। পাপাকে ছাড়া আমার কিছু ভাল লাগে না। মা-দাদা পাপার জন্য সবসময় কাঁদে।’
গুম হওয়া তেজগাঁওয়ের বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন মারুফা ইসলাম বলেন, ‘২০১৩ সালের ডিসেম্বরে আমার ভাই নিখোঁজ হয়। প্রধানমন্ত্রী আমাদের দিকে ফিরে তাকান। গুম হওয়া পরিবারগুলোর সদস্যরা বাঁচতে চায়।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘এরশাদ, আইয়ুবের শাসন গেছে, শেখ হাসিনার যে গুম, খুনের রাজনীতি তা আগে ছিল না। কথায় কথায় গুম, খুন করা করছে। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত। এখনো প্রতি রাত কেউ না কেউ উধাও হচ্ছে।’
জনগণ বিএনপির দিকে তাকিয়ে আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা যদি ফ্যাসিবাদ সরকারের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে না পারি, তাহলে জনগণ আমাদের ক্ষমা করবে না।’
দলের আরেক ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম বলেন, ‘স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর এমন বাংলাদেশ দেখতে হবে তা কল্পনা করিনি। যা এর আগে ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে। শুধু অশ্রু বিসর্জন দিলেই হবে না, শিশুদের কান্না আরও কত এভাবে দেখতে হবে, আমাদের রাজপথে নামতে হবে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।’
আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আরও বক্তব্য রাখেন— বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মানবাধিকার বিষয়ক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান প্রমুখ।
সভা সঞ্চালনা করেন বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন। তিনি বলেন, ‘চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৫৯ জন গুম হয়েছে।’