এসএসসির ফরম পূরণে বাড়তি টাকা আদায়ে এবারও ‘জবরদস্তি’
এসএসসির ফরম পূরণে বোর্ড নির্ধারিত ফি সর্বোচ্চ এক হাজার সাতশ টাকা নেয়ার কথা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু মিরপুরে সরকারি বাঙলা স্কুলে আদায় করা হচ্ছে আট হাজার টাকারও বেশি।
অতিরিক্ত টাকা আদায় করতে গিয়ে মার্চ মাস পর্যন্ত আগাম বেতন ধরা হয়েছে তিন হাজার টাকা। আবার মার্চ মাস পর্যন্ত অতিরিক্ত ক্লাস ও মডেল টেস্টের নামেও আদায় করা হচ্ছে আরও তিন হাজার টাকা। এর বাইরে ফেয়ারওয়েলের (বিদায় সংবর্ধনা) নামে আদায় করা হচ্ছে পাঁচশ টাকা, আর কেন্দ্র ব্যবহারিকের নামে নেয়া হচ্ছে তিনশ টাকা।
একাধিক অভিভাবক বলেন, তারা ডিসেম্বর পর্যন্ত বেতনসহ সব কিছু পরিশোধ করেছে। ফেব্রুয়ারির শুরুতে এসএসসি পরীক্ষা হবে। জানুয়ারি থেকে ক্লাস, কোচিং ও স্কুলের মডেল টেস্ট বন্ধ থাকবে। অথচ তাদের কাছ থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত বেতন আদায় করা হয়েছে। এছাড়া আদায় করা হয়েছে অতিরিক্ত ক্লাস ও মডেল টেস্টের টাকাও। এর প্রতিবাদও করা যায়নি। স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের একজন এবং প্রতিষ্ঠান প্রধান মিলে বাড়তি ফি আদায়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এ বিষয়ে বক্তব্য নেয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ আব্দুস ছালামের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
আগারগাঁও তালতলা সরকারি কলোনি উচ্চ বিদ্যালয় ও মহিলা কলেজেও বিজ্ঞান বিভাগে ৭ হাজার ৩০ এবং মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৬ হাজার টাকার বেশি আদায় করা হয়েছে।
রাজধানী ও বিভাগীয় শহরের মতো না হলেও মফস্বলের স্কুলগুলোতেও বাড়তি ফি আদায় করা হচ্ছে। পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার কালাইয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এসএসসির ফরম পূরণের জন্য ৩৫০০ টাকা নেয়া হচ্ছে। বাড়তি টাকা না দিলে ফরম পূরণ করতে দেয়া হচ্ছে না। আর কেউ অতিরিক্ত ক্লাস বা কোচিং না করতে চাইলেও তাকে দিতে হচ্ছে টাকা।
এটা কেবল চলতি বছরের সমস্যা না। প্রতি বছর শিক্ষাবোর্ড বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মানবিক, বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগে ফরম পূরণের জন্য আলাদা ফি নির্ধারণ করে দেয়। ব্যবহারিক পরীক্ষা থাকে বলে বিজ্ঞানে এই ফি থাকে বেশি। কিন্তু স্কুলে আদায় করা হয় এর দ্বিগুণ, তিনগুণ, চারগুণ বা তার চেয়ে বেশি।
এসব নিয়ে গণমাধ্যম সংবাদ প্রচার করে ভুরি ভুরি। শিক্ষাবোর্ড বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাবর কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দেয়। কিন্তু এর কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না। দুই একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলেও বাকি থেকে সিংহভাগ।
এবারও বাড়তি ফি আদায় নিয়ে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান সেই কথাই বলেছেন, যা এর আগে তার পূর্বসূরীরা বহুবার বলে গেছেন।
বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এসএসসির ফরম পূরণের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেছি। কিন্তু কেউ যদি অতিরিক্ত টাকা আদায় করে, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) আব্দুল মান্নান বলেন, এ বিষয়ে যদি কোনো অভিযোগ পাওয়া যায় তাহলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো। কোন ছাড় দেব না। তিনি বরিশালের একটি ঘটনার উদাহরণ টেনে বলেন, বরিশালের একটি স্কুলের বিষয়ে আমার কাছে অভিযোগ আসছিল। আমি তাৎক্ষণিকভাবে পদক্ষেপ নিয়েছি। কিন্তু তদন্ত করে দেখা গেছে ঘটনা সত্য নয়। মনে হয়েছে বিষয়টি অনেকেই চেপে গেছেন। এভাবে হলে হবে না। ঘটনার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে মানুষের হয়রানি লাঘবে আমি বদ্ধপরিকর।
একই অভিযোগ ছিল গতবছরও
এসএসসির ফরম পূরণে অতিরিক্ত টাকা নেয়ার এমন অভিযোগ ছিল গতবছরও। তখন টাকার ফেরত দেয়ার বিষয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আন্দোলন হয়। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে অতিরিক্ত টাকা ফেরত নেয়ার বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হয়। ওই সময় অনেক স্কুল টাকা ফেরত দিয়েছে বলে জানায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা গেছে, রাজধানীসহ দেশের প্রায় সব স্কুলেই অতিরিক্ত টাকা নেয়া হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিতে এসেছে এগুলোর খুব কমই।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গতবছর তিন হাজার ৩৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণে অতিরিক্ত টাকা আদায় করার অভিযোগ পায় তারা। এর মধ্যে ৮০৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত অর্থ ফেরত দিয়েছে। ৯৯৯টি প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, তারা বাড়তি টাকা নেয়নি। আর বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো পরবর্তীতে সমন্বয় করবে বলে জানিয়েছে।
বছরের শুরুতে যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেতন-ফি বাবদ অতিরিক্ত টাকা নিয়েছে সেগুলোর তালিকা করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) তদন্ত প্রতিবেদন দেয়। এ ছাড়া সরকারের আরেকটি এজেন্সির মাধ্যমেও এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু এই পর্যন্তই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েল ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এসএসসির ফরম পূরণে বাড়তি টাকা আদায় করা একটি পুঁজিবাদী ধ্যান ধারণা। এ থেকে আমাদের বের হতে হবে। আর বারবারই একই অভিযোগ যখন পাওয়া যাবে তখন বুঝতে হবে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের এতে গাফিলতি রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছি। গত বছরও কাউকে ছাড় দেইনি। এবারও যদি কেউ বাড়তি টাকা নেয় তাহলে আর ছাড় দেয়া হবে না।’