বিজিবি অফিসারদের আচরণ পাল্টানোর পরামর্শ হাইকোর্টের
সীমান্তরক্ষী বাহিনীতে বিদ্রোহের মতো পরিস্থিতি এড়াতে সৈনিকদের সঙ্গে অফিসারদের ‘উপনিবেশিক আচরণ ও ইগো’ থেকে বেরিয়ে আসার তাগিদ দিয়েছে উচ্চ আদালত। পিলখানায় হত্যা মামলার রায় ঘোষণায় হাইকোর্ট বলেছে, ‘সৈনিকরা কারো সন্তান, কারো ভাই, কারো আত্মীয় এরা এদেশেরই সন্তান। যে কোনো বাহিনীতে অধস্তনদের সঙ্গে ঊর্ধ্বতনদের পেশাদারিত্বমূলক সম্পর্ক বজায় রাখা উচিৎ।’
বিচারপতি মো. শওকত হোসেনসহ তিন সদস্যের বৃহত্তর হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় ঘোষণার সময় এই মন্তব্য করে। বেঞ্চের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার।
গতকাল রবিবার থেকে মামলাটির রায় ঘোষণা শুরু করা হয়। গতকাল থেকে সোমবার বেলা একটা পর্যন্ত রায়ের পর্যবেক্ষণ পড়ে শেষ করে আদালত। এরপর বেলা ২টা ৩৭ মিনিটে মামলায় আসামিদের সাজার অংশ পড়া শুরু করা হয়।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বাজার নিয়ন্ত্রণ বিডিআরের (বিজিবির আগের নাম) তত্ত্বাবধানে অপারেশন ডাল-ভাতের মতো কর্মসূচি নেওয়া ঠিক হয়নি। বিদ্রোহের আগে গোয়েন্দারা কেন এই সম্ভাবনার তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছিল তা তদন্ত করে দেখারও সুপারিশ করা হয়েছে রায়ে। রায়ে মোট সাতটি সুপারিশ করা হয়েছে।
# বিডিআরের মতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে ডালভাত কর্মসূচির মতো কর্মসূচি নেওয়া উচিৎ নয়।
# বাহিনীতে অধস্তনদের সঙ্গে ঊর্ধ্বতনদের পেশাদারিত্বমূলক সম্পর্ক বজায় রাখা উচিৎ। বাহিনীর আইন অনুযায়ী সে সম্পর্ক প্রতিপালন করা প্রয়োজন। এজন্য সময় সময় মতবিনিময় করা প্রয়োজন।
# পিলখানায় বিদ্রোহের আগে অধঃস্তনদের কিছু দাবিদাওয়া বিডিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। এ ধরনের আমলাতান্ত্রিকতা দূর করতে হবে।
# বাহিনীতে প্রচ্ছন্ন ক্ষোভ থেকে থাকলে, জরুরি ভিত্তিতে তা প্রশমন করার উদ্যোগ নেওয়া।
# বাহিনীতে কারও কোনো পাওনা থাকলে তাও দ্রুত পরিশোধ করা।
# বিডিআরের নিজস্ব গোয়েন্দা থাকলেও বিদ্রোহের আগে তথ্য দিতে তাদের ব্যর্থতা তদন্ত করা।
গতকাল রবিবার দেয়া পর্যবেক্ষণে আদালত এই বিদ্রোহে ষড়যন্ত্র রয়েছে বলেও মত প্রকাশ করা হয়। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় যে হত্যাযজ্ঞ চলেছিল তাকে ইতিহাসের জঘন্যতম ও বর্বরোচিত আখ্যা দেয়া হয়।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদরদপ্তর পিলখানায় বাহিনীটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের দরবারে আটকে রেখে বিদ্রোহ করে সৈনিকরা। দুই দিনের বিদ্রোহে বাহিনীতে কাজ করতে আসা সেনাবাহিনীর ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে বাহিনীটির সে সময়ের মহাপরিচালক শাকিল আহমেদও ছিলেন। এই বিদ্রোহ পড়ে ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাহিনীটির ক্যাম্পে।
২৬ ফেব্রুয়ারি জাতির উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণে বিদ্রোহী সৈনিকদের প্রতি হুঁশিয়ারি দেয়ার পর অস্ত্র সমর্পণ করে বিদ্রোহী সেনারা। তবে ততক্ষণে পিলখানা থেকে পালিয়ে যায় বেশিরভাগ বিদ্রোহী। পরে তাদের প্রায় সবাই ধরা পড়ে অথবা আত্মসমর্পণ করে।
সেনাবাহিনী পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার কাহিনি জানা যায়। এই ঘটনায় করা ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ১৫২ আসামির ফাঁসির রায় দেন ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. আখতারুজ্জামান।
এছাড়াও ১৬১ জনকে দেয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ২৫৬ জনকে তিন থেকে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেয়া হয়। ২৭৭ জনকে বেকসুর খালাসও দেন বিচারক।
এরপর বিচারিক আদালতের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ অনুমোদন এবং আসামিদের আপিলের শুনানি শুরু হয় উচ্চ আদালতে।