বৈমানিক হওয়ার স্বপ্ন অধরাই রইল বাঁধনের
মজিবুর রহমান-হাসনে আরা বেগম দম্পতির প্রথম সন্তান এম হাসান রহমান বাঁধন (২৬)। শনিবার রাতে আমেরিকায় দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন বাঁধন। তার লাশ পাঠানোর কাগজপত্র ঠিকঠাক করতে সময় লাগায় বুধবারও তার লাশ দেশে আসছে না বলে জানালেন বাঁধনের বাবা প্রকৌশলী মো. মুজিবুর রহমান।
বাবা মজিবুর রহমান ঢাকার আবেদ হোল্ডিংস লিমিটেডের জেষ্ঠ্য প্রকৌশলী। মা হাসনে আরা বেগম বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল)-এর প্রিন্সিপাল অফিসার। মারজানা রহমান ভাবনা নামে তাদের এক কন্যা সন্তান রয়েছে। ভাবনা ঢাকার উত্তরার আইইউবিটি-তে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং শাখায় তৃতীয় বর্ষে পড়েন।
তার বাবা মুজিবুর রহমান ঢাকাটাইমসকে জানান, ছোটবেলা থেকেই বাঁধন উড়োজাহাজ, রেলগাড়িসহ বিভিন্ন যানবাহনের খেলনা নিয়ে খেলতে বেশি পছন্দ করতো। যখন সে প্রাইমারি স্কুলে পড়ত তখন তাকে এসব খেলনা কিনে দিলে খেলনাগুলো নিয়ে সে খাটের নিচে চলে যেত। লুকিয়ে লকিয়ে সে ওই খেলনাগুলোর স্ক্রু খুলে ফেলত। পরে আবার স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে পুরো খেলনাটি ফিটিং করে ফেলত। এ কাজটি শেষ করতে পারলে সে খুব আনন্দ প্রকাশ করতো। তার মাকে ডেকে বলত আমি খুলে আাবার ঠিক করতে পেরেছি। আর না পারলে সেদিন মনটা খুব খারাপ হতো। পরদিন আবার সে চেষ্টা করতো। তার এ কাজে উৎসাহ দিতে আমি তাকে একটি টুল বক্সও কিনে দিয়েছিলাম। হাইস্কুল জীবন থেকেই তার খুব ইচ্ছে ছিল উড়োজাহাজ বানানোর কাজ শেখার এবং বৈমানিক হওয়ার। এখনো তার ওইসব খেলনা সংরক্ষণে আছে।
বাঁধন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের রাণী বিলাসমণি উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ও পরে ঢাকার উত্তরা হাই স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে ঢাকা বিজ্ঞান কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এসএসসি এবং এইচএসসি উভয় পরীক্ষায় তিনি ‘এ’ গ্রেড পেয়েছিলেন। তারপরও তার ইচ্ছার প্রতি আগ্রহ দেখিয়ে তাকে আমেরিকার কানসাসে উইচিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি করা হয়। ২০১১ সালের ৩ মে এরোনেটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার পড়তে যুক্তরাষ্ট্রে যান বাঁধন। সেখানে লেখাপড়ার শেষ পর্যায়ে দুই মাস আগে বাঁধন আমেরিকায় বৈমানিকের জন্য আবেদন করেছিলেন।মৌখিক পরীক্ষায় রেকর্ড মার্ক (৮৭ নম্বর) পেয়েছিলেন, তিনি স্বাস্থ্য পরীক্ষায় টিকেও গিয়েছিলেন। চাকরির চূড়ান্ত অবস্থায় তাকে পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছিল। গেল নভেম্বরে তার নিয়োগ পাওয়ার কথা ছিল।
বাঁধনের মা হাসনা আরা বেগম বলেন, গত বৃহস্পতিবার রাতে ছেলের সাথে তার দুইবার কথা হয়। আলাপচারিতায় বেশ কয়েকবার মাকে উড়োজাহাজে করে আমেরিকা নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছে বাঁধন। আমাকে নিয়ে অনেক জায়গায় বেড়ানোর গল্পও শোনায় বাঁধন। কিন্তু আজ সবই স্মৃতি হয়ে গেল।
মা বলেন, তার ছেলে বাঁধনের সাথে ছোটবেলার বন্ধু নাঈম আমেরিকার কানসাসে একই সাথে থাকত। রবিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে তিনি প্রথম বাঁধন নিহতের খবর পান। আমেরিকার পুলিশের উদ্ধৃতি দিয়ে দুর্বৃত্তরা গুলি করে বাঁধনকে হত্যা করেছে বলে তাকে এ খবর জানানো হয়।
নাঈম জানান, বাঁধন গত দুই মাস ধরে পিৎজা হাট ডেলিভারির জন্য খণ্ডকালীন কাজ নিয়েছিলেন। প্রতিদিন রাত সাড়ে ১১টা সাড়ে ১২টার মধ্যে ঘরে ফিরে আসতেন। কিন্তু শনিবার গভীর রাত পর্যন্ত বাঁধন ঘরে না ফেরাতে আমি (নঈম) তাঁকে খুঁজতে রাত তিনটা বিভিন্ন হসপিটালের ইমার্জেন্সিতে খোঁজ নিই। পিৎজা হাটের ম্যানেজার বাঁধনকে ফোনেও যোগাযোগে ব্যর্থ হয়ে তার সন্ধানের জন্য পুলিশকে জানান। পরে রবিবার বেলা ১১টার দিকে ক্যানসাসের ৭৮০০ পেজন্ট লাইভ ওক স্ট্রিট অ্যাপার্টমেন্টের সামনে তার পিৎজা ডেলিভারির গাড়ির ট্যাংক থেকে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে। ধারণা করা হচ্ছে, দুর্বৃত্তরা তাঁকে গুলি করার পর গাড়ির ট্যাংকে ঢুকিয়ে নিয়ে এ এলাকায় ফেলে যায়। পুলিশ নিশ্চিত করেছেন, গাড়িটি তাঁর (বাঁধন)। এ ব্যাপারে পুলিশ জনগণের সহযোগিতা কামনা করেছেন। বর্তমানে লাশটি ক্যান্সাস হাসপাতালের মর্গে হিমঘরে রয়েছে। কিছু প্যাপারস তৈরিতে বিলম্ব হওয়ায় লাশ দেশে পাঠাতে একটু সময় লাগছে।
বাঁধনের বাবা মজিবুর রহমান বলেন, গত শুক্রবার বাঁধনের সাথে আমার সবশেষ কথা হয়েছে। টাকা পয়সা লাগবে কি না, শরীরের কী অবস্থা ইত্যাদি নিয়ে কথা হয়েছে। সেও পরিবারের খোঁজখবর নিয়েছে। ২০১১ সনের পর সে কখনো দেশে আসেনি।
তাদের পৈত্রিক বাড়ি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার রাজাবাড়ি চিনাশুখানিয়া এলাকায়। ১৯৯৮সালে পাঁচ কাঠা জমি কিনে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের তেলিপাড়া এলাকায় ঘরবাড়ি করে স্ব-পরিবারে বসবাস করছেন।
বাঁধনের মামা হুমায়ুন কবির বলেন, বাঁধন কোর্স কমপ্লিট করেছে। এখন তার বাবা-মা তৈরি করা সুখের ছবি দেখত। কিন্তু নিয়তি সব পাল্টে দিয়েছে।
প্রতিবেশী আবুল হাশেম বলেন, শান্ত ও বিনয়ী স্বভাবের ছেলে ছিল বাঁধন। এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠদের শ্রদ্ধা ও ছোটদের স্নেহ করত। এলাকার লোকদেরও দোয়া ছিল তার ওপর। গাজীপুর মহানগরের ১৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সফর আলীও একই অভিমত দেন।