মহাকালের রেখাপাত
স্বকৃত নোমান, কথাসাহিত্যিক
কোনো কোনো সকালে ঘুম থেকে জাগার পর মনে হয়, এই পৃথিবীতে আমার কী কাজ? কেন এসেছি? জন্মের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কী? আগে মনে হতো, লিখব বলে জন্মেছি। এখন মনে হয় লিখছি কেন? কার জন্য? মানুষের জন্য? এটা একটা ভূয়া কথা। সম্পূর্ণ মিথ্যাচার। কোনো লেখকই মানুষের জন্য লেখে না, মানুষের প্রতি তার কোনো দায় নেই, কেউ তাকে মানুষের ঠিকাদারি দেয়নি। সে লেখে আসলে নিজের জন্যই। এই বিশাল পৃথিবীতে নিজের একাকীত্ব টের পেয়ে যে বিপুল বিপন্নতা তৈরি হয় তার ভেতর, তার কবল থেকে বাঁচার জন্যই সে লেখে। অর্থাৎ সে নিজের জন্যই লেখে। নিজেকে মহান করার জন্য সে নিজের জন্য করা কাজকে অন্যের জন্য করা কাজ বলে চালিয়ে দেয়।
নিজেকে মহান করে তোলার এই স্বভাব কি মানুষের রক্তগত? হয়ত। কখনো কখনো সকালের রৌদ্রকরোজ্জ্বল আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, এই যে আমি একজন মানুষ, আমার মহানতা আসলে কোথায়? এই বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তো আমার কোনো অস্তিত্বই নেই। ব্রহ্মাণ্ডে কত কত গ্রহ, কত কত উপগ্রহ। আমি কি নিশ্চিত এই পৃথিবীর বাইরে অন্য কোনো গ্রহে অন্য কোনো প্রাণী নেই? পৃথিবী নামক গ্রহে যদি প্রাণী থাকে, অন্য গ্রহগুলোতেও প্রাণের অস্তিত্ব থাকার কথা। থাকাটা যৌক্তিক। অথচ আমি ভাবছি এই পৃথিবীই একমাত্র সত্য। এর বাইরে আর কোনো সত্য নেই। আমিই একমাত্র সত্য, আমরাই একমাত্র সত্য। আমরাই শ্রেষ্ঠ। স্রষ্টা সারাক্ষণ আমাদের নিয়েই ব্যস্ত। তিনি আমাদের স্বর্গ দেবেন, না নরক দেবেন—এই হিসাব নিয়েই তিনি অস্থির।
এই পৃথিবীতে আমার থাকাটা আসলে খুবই তুচ্ছ একটি ঘটনা। না থাকাটাও একটি তুচ্ছ ঘটনা। হোমার ছিলেন, এখন নেই। তার থাকাটা যেমন তুচ্ছ ছিল, না থাকাটাও এই মহাবিশ্বের কাছে তেমনই তুচ্ছ। ফেরদৌসী ছিলেন, বাল্মিকী ছিলেন, বেদব্যাস ছিলেন, তলস্তয় ছিলেন, জোলা ছিলেন, মার্কেস ছিলেন। এই মহাবিবিশ্বের কাছে তাদের থাকাটা মোটেই তাৎপর্যপূর্ণ কিছু ছিল না। এখন যে নেই, তাও তেমন বিশেষ বেদনাদায়ক কোনো ঘটনা নয়। আমরা, অর্থাৎ মানুষেরা, আসলে প্রত্যেকেই একেকটি ঢেউ। সমুদ্রতটে যেমন ঢেউ আছড়ে পড়ে, মুহূর্তের জন্য; মহাকালের কাছে, মহাবিশ্বের কাছে আমরাও ঠিক তাই। আমরা একটি ক্ষণস্থায়ী ঢেউ মাত্র। ঢেউ কখন এলো, কখন মিলিয়ে গেল, মহাসমুদ্র সেই হিসাব রাখে না। সে এতই বিশাল যে, তার হিসাব রাখার দরকার পড়ে না।
স্রষ্টা বলে কেউ থেকে থাকলে, তিনি এতই বিরাট-বিশাল যে, আমার মতো, আমাদের মতো তুচ্ছাতিতুচ্ছ প্রাণীদের নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। আমরা কি পচা কলার ভেতর জন্মানো কীটকে দেখি? সেই কীট নিয়ে ভাবি? সেই কীট নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা আছে? নেই। আমরা কি পিপড়া নিয়ে ভাবি? মানুষের পায়ের তলায় প্রতিদিন কত হাজার পিপড়া মারা যাচ্ছে, তা নিয়ে কি আমরা চিন্তিত? প্রতিদিন কত লক্ষ-কোটি মশা জন্ম নিচ্ছে আর মরে যাচ্ছে, তা নিয়ে আমরা কি ভাবি? না, এটা ভাবার কোনো বিষয়ই না আমাদের কাছে। কারণ কীটের তুলনায়, পিপড়ার তুলনায়, মশার তুলনায় আমরা বিশালকায়, শক্তিশালী।
আর এই মহাবিশ্বের বিরাটত্বের তুলনায় আমরা এইসব কীট-পিপড়া আর মশারও অধম। বিরাট-বিশাল স্রষ্টার কাছে আসলে আমাদের কোনো অস্তিত্বই নেই। আমরা তার মাথাব্যথার কারণ নই, দুশ্চিন্তার কারণ নই। তিনি আমাদের নিয়ে মোটেই ব্যস্ত নন, মোটেই অস্থির নন। আমরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করছি। এই অস্থিরতার কারণ আসলে মৃত্যু। মৃত্যুকে আমাদের কাছে মনে হয় এক ভয়াবহ বিভীষিকা। কারণ মৃত্যু আমরা দেখিনি। কীভাবে মানুষ মরে যায়, মরার সময় কী অনুভূতি হয়, মরার পর মানুষ কোথায় চলে যায়, তা আমরা জানি না। অজানাকে আমাদের খুব ভয়। সেই ভয় থেকেই আমাদের চরম অস্থিরতা।
আমি ভাবি স্পিনোজার কথা। স্পিনোজার ঈশ্বর বলতেন, প্রিয় মানুষেরা, আমি যা কিছু দিয়ে তোমাকে সৃষ্টি করেছি তার জন্য কীভাবে তোমাকে দোষ দেব? আমি যেমনটা তোমাকে সৃষ্টি করেছি, তেমনটা হওয়ার জন্য তোমাকে কেন শাস্তি দেব? তুমি কি মনে কর যে আমি আমার যে সমস্ত সৃষ্টি খারাপ কাজ করে, তাদের পোড়াতে একটি জায়গা তৈরি করেছি? ঈশ্বর কি এমনটা করতে পারে? আমিই যদি তোমাদের সৃষ্টি করে থাকি, তোমার আবেগ, সীমাবন্ধতা, আনন্দ, অনুভূতি, প্রয়োজন, অসঙ্গতি সবই দিয়েছি আমি। আমি তোমাকে যা দিয়ে সৃষ্টি করেছি তার জন্য কীভাবে তোমাদের দোষ দেব আমি? তেমনটি হওয়ার জন্য কেন আমি তোমাকে শাস্তি দেব যেমনটি আমি তোমাকে সৃষ্টি করেছি? তোমাকে পোড়ানোর জন্য কোনো নরক আমি বানাইনি। কোন ঈশ্বর কি পারে তার নিজের সৃষ্টিকে পোড়াতে?
ঠিকই তো। আমার মধ্যে যে ভালো ও মন্দের মিশ্রণ, তার পেছনে তো আমার হাত নেই। আমি তো বলিনি, হে প্রভু, আমার ভেতরে এক চটাক বা এক লিটার মন্দ ঢেলে দাও। ‘হক কলন্দর, সব কি আন্দর, এক কালা বান্দর, ওহ্ শয়তান হ্যায়।’ সব মানুষের ভেতেরই একটা কালো বাঁদরের বসত। সেটাই শয়তান, সেটাই রিপু, সেটাই অসুর। সেই অসুরকে আমি আহ্বান করিনি। বলিনি, আসো, আমার ভেতরে স্থিত হও। স্রষ্টাই তাকে আমার ভেতরে প্রবিষ্ট করে দিয়েছেন। সুতরাং তার দায় তো আমার নয়, আমার হতে পারে না। যে দায় আমার নয়, তার জন্য তো আমি শাস্তি পেতে পারি না।
সুতরাং, স্পিনোজার ঈশ্বর বলেন, হে প্রিয় মানুষেরা, তোমাদের জানা প্রয়োজন, এই জীবন কোনও পরীক্ষাগার নয়। এই জীবন স্বর্গের পথে পা বাড়ানোর কোন মহড়া নয়। এই জীবন শুধু পৃথিবীর জন্যই। এই জীবনের পরে আরও কিছু আছে কিনা তা আমি তোমাকে বলতে পারি না। তবে আমি একটি পরামর্শ দিতে পারি। শুধু বাঁচো, এমনভাবে বাঁচো, যেন এরপর আর কিছু নেই। যেন এটি তোমার উপভোগ করার, ভালোবাসার আর বেঁচে থাকার একমাত্র সুযোগ। তুমি যে সুযোগটি পেয়েছ, তা উপভোগ কর। তুমি ঠিক বা ভুল আচরণ করেছ কিনা আমি প্রশ্ন করব না। বরং আমি জিজ্ঞাসা করব তুমি কি পৃথিবীর জীবন পছন্দ করেছ? সেখানে কি আনন্দে ছিল? তুমি পৃথিবীতে কি সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেছিলে? তুমি পৃথিবীতে কী শিখেছো? আমি চাই না তুমি আমাকে বিশ্বাস কর, আমি চাই তুমি নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখ, নিজেকে বিশ্বাস কর। যখন তোমার প্রিয়জনকে চুম্বন করবে সেখানে যেন আমায় খুঁজে পাও। তোমার ছোট্ট মেয়েকে যখন আদর করবে, তোমার পোষা প্রাণীর যখন যত্ন নেবে; যখন সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে গভীর শ্বাস নেবে, সেখানেই আমাকে খুঁজে পাবে, খুঁজে দেখো।
রবীন্দ্রনাথ এই সত্য বুঝেছিলেন। তাই তিনি হিমালয় অববাহিকার দেশ থেকে গেয়ে উঠলেন, ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ/ধন্য হল ধন্য হল মানবজীবন।’ সকল সাধকই এই সত্য বুঝতে পারেন। ফলে জীবন তার কাছে নরক হয়ে ওঠে না, স্বর্গ হয়ে ওঠে। এই পৃথিবী তার কাছে হয়ে ওঠে এক মনোরম আনন্দ নিকেতন।